তোমার বন্ধু মেহেদী। প্রফুল্ল চেহারা হাসিখুশি ছেলে। বিষন্নতা তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। কান্নাকাটি দূরের কথা, কখনো গোমড়ামুখেও দেখা যায় না তাকে। সেই মেহেদী এক সন্ধ্যায় তোমাকে ফোন দিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, 'বাবা ভীষণ অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। বড়সড় স্ট্রোক করেছে। ডাক্তার রাজীব হোসাইনন বলেছেন, মেজর একটা অপারেশন করতে হবে। সে জন্য বেশ কয়েক ব্যাগ রক্ত লাগবে। বাবার রক্তের গ্রুপ A পজেটিভ। তোর রক্তের গ্রুপও তো A পজেটিভ। তুই কি পারবি রক্ত দিতে?'
প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এই মহাবিপর্যয়ের দিনে তুমি তার পাশে দাঁড়াতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলে হাসপাতলে। মেহেদীর কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দিলে। তারপর গেলে রক্ত দিতে।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে তোমার মনে কি প্রশ্ন জেগেছে যে, কেন রক্ত দিতে হলে রক্তদাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ একই হতে হবে? অন্য গ্রুপের রক্ত কেন দেওয়া যায় না? দিলে কি সমস্যা হবে? তোমার রক্তের গ্রুপ যে A পজেটিভ এটাই বা কিভাবে জানা গেল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই এই লেখাটি।
প্রথমেই আসি রক্তের গ্রুপ বা ব্লাড গ্রুপিংয়ের ব্যাপারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রধানত দুই ধরনের ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম প্রচলিত আছে- ABO ব্লাড গ্রুপ আর Rh ব্লাড গ্রুপ। ABO ব্লাড গ্রুপে আছে চার ধরনের ব্লাড- A, B, AB, আর O। Rh ব্লাড গ্রুপে আছে দুই ধরনের ব্লাড- Rh পজিটিভ আর Rh নেগেটিভ। আমাদের গল্পটিতে তোমার রক্তের গ্রুপ A পজেটিভ (নিজের ব্লাড গ্রুপও A পজিটিভ কিনা!)। তাহলে তোমার রক্তের গ্রুপের প্রথম অংশটি জানা যাবে ABO ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে। অর্থাৎ কারো রক্ত কোন গ্রুপের- A, B, AB নাকি O গ্রুপ তা জানা যায় ABO ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে। আর Rh ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে জানা যাবে তোমার রক্তের গ্রুপের দ্বিতীয় অংশটি। অর্থাৎ কেউ শরীরে পজেটিভ না নেগেটিভ রক্ত বহন করছে তা জানা যায় Rh ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম থেকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয় কিভাবে?
রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয় রক্তের লোহিতকণিকার (RBC) আবরণীতে থাকা এন্টিজেনের উপস্থিতি থেকে। রক্তের গ্রুপ A হলে RBC তে a এন্টিজেন রক্তের গ্রুপ B হলে b এন্টিজেন আর রক্তের গ্রুপ AB হলে a, b দুইটা এন্টিজেনই থাকবে। আর রক্তের গ্রুপ যদি O হয় তাহলে কোনো এন্টিজেনই থাকবে না। আর RBC র আবরণীতে যদি Rh এন্টিজেন থাকে তাহলে রক্ত পজেটিভ, না থাকলে নেগেটিভ।
এখন তোমার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে রক্তে অ্যান্টিজেন ব্যাটার থাকা না থাকাটাই কি সব? বুঝবো কি করে কোন এন্টিজেন লুকিয়ে আছে আমার RBC র পর্দার আড়ালে?
হুম, ভালো প্রশ্ন। কোন এন্টিজেন আছে বা আদৌ আছে কিনা এটা বোঝা যায় এন্টিজেনের জাতশত্রু এন্টিবডিকে ধরে নিয়ে আসলে। এইজন্য তোমার আঙুলে আলতোভাবে ফুটো করে একটা স্লাইডে তিন ফোঁটা রক্ত নেয়া হবে। তাতে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ফোঁটোতে যোগ করা হবে যথাক্রমে এন্টিবডি Anti-A, Anti-B, Anti-D। তখন যদি এন্টিজেন-এন্টিবডি বিক্রিয়া হয় অর্থাৎ এন্টিবডি যদি তার দোস্ত (পড়ুন শত্রু) এন্টিজেন কে চিনতে পেরে যুদ্ধ বাধিয়ে বসে তাহলে সব RBC রা একজোট হয়ে বিদ্রোহ করে। RBC দের একসাথে হওয়ার এই ঘটনাকে বলে Clotting বা রক্ত জমাট বাঁধা। জমাট বাঁধা রক্ত দেখলে মনে হয় এটি লাল আর হলুদ দুইটা অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। লাল অংশটি লোহিত রক্তকণিকা বা RBC আর হলুদ অংশটি হচ্ছে সেরাম। এন্টিবডি যোগ করার পর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটতে পারে-
ঘটনা-১: যদি Anti-A যোগ করা রক্তের ফোঁটা লাল-হলুদ অংশে বিভক্ত হয় তাহলে বুঝতে হবে তোমার রক্তের গ্রুপ A।
ঘটনা-২: যদি Anti-B যোগ করা রক্তের ফোঁটাটি জমাট বাঁধে তাহলে তোমার রক্তের গ্রুপ B।
ঘটনা-৩: যদি দুটো রক্তের ফোঁটাই জমাট বাঁধে তাহলে তোমার রক্তে AB গ্রুপের।
ঘটনা-৪: যদি দুটোর কোনটাই জমাট না বাঁধে তাহলে তোমার রক্তের গ্রুপ O।
এখন, অবশিষ্ট থাকল তৃতীয় রক্তবিন্দু। এতে যোগ করা হয়েছে Anti-D। এক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। যদি রক্ত জমাট বাঁধে তাহলে রক্তের গ্রুপ Rh পজেটিভ, না বাঁধলে Rh নেগেটিভ।
এখানে আরো কিছু মজার ব্যাপার আছে। তোমার এক বড় আপু অহনার রক্তের গ্রুপ O। অহনা সবাইকে রক্ত দিতে পারবে। কারণ, O গ্রুপের রক্তে কোনো এন্টিজেন থাকে না। তাই শরীরে O গ্রুপের রক্ত দেয়া হলে এন্টিবডি এসে ঝামেলা করার কোন সুযোগই পাবে না। এজন্য O (নেগেটিভ) ব্লাড গ্রুপকে বলা হয় Universal Donor। আবার তোমার আরেক বন্ধু তিতিরের রক্তের গ্রুপ AB। সে সব গ্রুপের রক্ত নিতে পারবে। এজন্য AB ব্লাড গ্রুপকে বলা হয় Universal Receiver।
এখন সেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, কেন তোমাকে মেহেদী তার বাবার সাথে তোমার ব্লাড গ্রুপ মেলে বলে তোমাকে রক্ত দিতে বলল? অন্য গ্রুপের রক্ত দিলে কি হবে?
যদি দাতার ব্লাড গ্রুপ গ্রহীতার ব্লাড গ্রুপের সাথে না মেলে তাহলে নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখা দেবে। মুরগির খোয়ার আশ্রয়কেন্দ্র বানালেও বিপদ কাটবে না। আমাদের গল্পে, মেহেদীর বাবার রক্তের গ্রুপ A পজেটিভ। এখন তাকে যদি মেহেদীর বাবার বন্ধুর B পজিটিভ রক্ত দেওয়া হয় তাহলে মেহেদীর বাবার বন্ধুর রক্ত মেহেদীর বাবার রক্তপ্রবাহে মিশ্রিত হবার সাথে সাথে মেহেদীর বাবার শরীর কাঁপাকাঁপি শুরু করে দেবে, শরীরের অস্থিরতা ভর করবে, বমি বমি ভাব দেখা দেবে, তিনি বুকে-পিঠে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করবেন, তার শ্বাস-প্রশ্বাস ও পালস রেট বেড়ে যাবে, রক্তচাপ কমে যাবে। কিছুদিন পর আরও কিছু সমস্যা দেখা দেবে। যেমন- তার লোহিত রক্তকণিকা ভাঙতে শুরু করবে (Hemolysis)। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং তিনি জণ্ডিসে আক্রান্ত হবেন। এরপর তার কিডনি বিদ্রোহ করবে এবং সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে (Acute Renal Shutdown)। ফলে এক সপ্তাহের মাথায় তিনি মারা যাবেন। বুঝতেই পারছ কতটা ভয়াবহ ব্যাপার। দাতা ও গ্রহীতার রক্ত যদি একই গ্রুপের হয় তাহলেও এত নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। বিপদ ঘটতে পারে সেক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক বিপদ হিসেবে দেখা দিতে পারে জ্বর, এলার্জি, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রভৃতি। প্রলম্বিত বিপদ হিসেবে রক্তে অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে ভয়াবহ কিছু রোগজীবাণুর (যেমন- ভাইরাল হেপাটাইটিস, এইডস, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর)। তবে আশার কথা এই বিপদগুলো ঠেকানো যায় খুব সহজেই। এজন্য রক্ত দেওয়ার আগে কিছু টেস্ট করাতে হয়।
১. ক্রস ম্যচিং: দাতার রক্ত গ্রহীতার শরীরে প্রদান করা হলে কোন সমস্যা হবে কিনা তা জানা যায় ক্রস ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে। এটি একটি মজার টেস্ট। এতে দাতার লোহিত রক্তকণিকা (এন্টিজেন) আর গ্রহীতার সেরাম (এন্টিবডি) মিলিয়ে দেখা হয় রক্ত জমাট বাঁধে কিনা। জমাট বাঁধলে রক্ত দেওয়া যাবে না, না বাঁধলে দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে দাতার সেরামকে খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয় না কারণ গ্রহীতার সেরামের পরিমাণ বেশি থাকে।
২. স্ক্রিনিং: দাতার রক্তে রোগজীবাণু আছে কিনা পরীক্ষা করা হয়। ▪◾
[যতদূর মনে পড়ে, লেখাটি ব্যাপন '১৮ এর মে-জুন সংখ্যার; সাবরিনা আপুর লেখা। লেখাটি ভালো লাগায় তখন এই অংশটুকু কোট করে রেখেছিলাম। আজ দুপুরে একাডেমিক ক্লাস করায় এটার কথা মনে পড়ে। পরে অসংখ্য নোটের সিন্ধু সেঁচে খুঁজে বের করে শেয়ার করলাম। ঈষৎ পরিমার্জিত এবং পরিবর্ধিত।]
*শব্দটিকাঃ
Hemolysis: "hemo" (গ্রীক haima হতে আগত যার অর্থ blood/রক্ত) + "lysis" (গ্রীক lusis থেকে আগত যার অর্থ disintegration of cells/কোষের বিভাজন)।
লোহিত রক্তকণিকা বিভাজিত বা ভেঙে যাওয়ার ফলে হিমোগ্লোবিনের প্লাজমায় বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াই হলো Hemolysis।
-অনিক আব্দুল্লাহ।